বেতাগী প্রতিনিধি ॥ ‘স্যার সবার কথাই তো ল্যাখেন, মোর দুঃখের কথাও একটু লেক্ক্যায়া দিতে পারেন। মুই তো এহ্যান নানান অসুখ-বিসুখে অসহায়ের মধ্যে আছি। মোরে তো কেউ সাহায্যেও করে না’। কথাগুলো অতি কষ্টে বলেছিল বরগুনার বেতাগী পৌর শহরে খবরের কাগজ বিক্রেতা কৃষ্ণ কান্ত বাড়ৈ। বয়স ২৯ বছর। একান্ত আলোচনার সময় জানা যায়, প্রতিদিন ভোরের আলো ফোটার পরপরই মানুষের দ্বারে দ্বারে খবরের কাগজ পৌঁছে দেন কৃষ্ণ। রোদ, বৃষ্টি, ঝড় উপেক্ষা করে পত্রিকা বিলি করাই তার কাজ। কৃষ্ণ শৈশব, কৈশোর ও যৌবনের অনেক সময়ই পার করছে খবরের কাগজ বিক্রি করে। গত ২০ বছর যাবৎ খবরের কাগজের ফেরিওয়ালার কাজ করে সে। বিভিন্ন দপ্তরের সরকারি কর্মকর্তা, রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তি, স্কুল-কলেজের শিক্ষক, ব্যবসায়ীসহ এলাকার সকল পেশার মানুষ তাকে এক নামেই চেনেন। পত্রিকা বিলি করতে গিয়ে সকলের সাথে পরিচয় হয় তাঁর। কিন্তু লোকলজ্জার ভয়ে নিজের জীবনের অসহায়ত্বের কথা কখনো কাউকে বলতে পারেননি। সমাজের খ্যাতিমান ব্যক্তিরা তাঁর কষ্টের কথা জানতেও পারেননি কখনো। কৃষ্ণ কান্তের বাড়ি উপজেলার বুড়ামজুমদার ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের বদনীখালী বাজারে। সেখানে মাত্র ৪ শতাংশ জমি ও একটি মাথা গোঁজার মতো ছোট ঘর ছিল। কৃষ্ণর বয়স যখন ৭ বছর তখন তাঁর বাবা দিনমজুর ধীরেন চন্দ্র বাড়ৈ ১৯৯৯ সালে ২৭ জুলাই অর্থাভাবে এক দুরারোগ্য রোগে মারা যান। তাঁর মা লক্ষ্মী রাণী বাড়ৈ হার্টের রোগী থাকায় স্বামী মৃত্যু শোক সইতে না পেরে পরের দিন ২৮ জুলাই মারা যান। এরপর কৃষ্ণ ও তাঁর ২ বছরের বড় ভাই শংকর বাড়ৈর জীবনে নেমে আসে কালো অধ্যায়। বেঁচে থাকার জন্য দুই শিশু দিনমজুরের কাজ করে। কাজ না পেলে ভিক্ষা করে কিংবা কারো কাছে সাহায্যে চেয়ে কোনোরকম বেঁচে থাকে। দুই বছর পরে কৃষ্ণর বয়স যখন মাত্র ৯ বছর তখন খবর কাগজ বিক্রি করার জন্য বেতাগী পৌর শহরে চলে আসে। খবর কাগজ বিক্রি করে মাসে ৩ হাজার টাকা উপার্জন করে। গত ৭ বছর যাবৎ তাঁর অস্থিক্ষয়জনিত রোগ দেখা দেয়। তার অসহায়ত্বের কথা জেনে কিছু মানুষ সাহায্যে করলে সেই টাকা দিয়ে চিকিৎসাসেবা নেয়। নিয়মিত ওষুধ কিনে খেতে পারছে না। পা দিয়ে ভালোভাবে হাঁটতে পারছে না। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হেঁটে খবরের কাগজ প্রতিদিন কত খবর পৌঁছে দেন মানুষের দ্বারে দ্বারে। সঠিক সময় খবরের কাগজ দিয়ে সবাইকে খুশি করে সে। এ কাজে সে আনন্দ পায়। কিন্তু নিজের জীবনের খবরটাই সে অনেক সময় ভুলে যায়। কৃষ্ণ জানায়, ‘ট্যাকার অভাবে ওষুধ খাইতে পারি না। বর্তমানে লকডাউনে পেপারও বেচতে পারি না। এ্যাহন মুই অসহায়’। সে আরো জানায়, ‘মোরে কেউ যদি একটা রিকশা কিনে দিলে পেপারগুলো মুই ভালোভাবে দিতে পারতাম’। এ বিষয় পৌরসভার ৬ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো. লুৎফার রহমান ফিরোজ বলেন, ‘এর পূর্বে কৃষ্ণকে বিভিন্ন সময় সাহায্য করা হয়েছে। ভবিষ্যতেও এ ধারা অব্যাহত থাকবে’।
Leave a Reply